রহস্যময় এক দেশ উত্তর কোরিয়া । আর দেশটির রহস্যময় প্রেসিডেন্ট কিন জং উন। নিজের বাবা এবং দাদার মতোই, কিম জং উনেরও দেশের জনজীবন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান নেই। তবে আজকের এই আলোচনায় থাকবে উত্তর কোরিয়ার এই শাসকের সঙ্গিনী ও দেশটির ফার্স্ট লেডি অর্থাৎ কিম জং উনের স্ত্রী ‘রি সল জু’।

মূলত ২০১২ সাল থেকে কিন জং উনের পাশে মাঝেমধ্যেই এক নারীকে দেখা যেতে শুরু করে। এরপর থেকে এই নারীকে নিয়ে বাড়তে থাকে মানুষের আগ্রহ ও কৌতূহল। কিছুদিনের মধ্যেই জানা যায়, তিনি দেশটির ফার্স্ট লেডি অর্থাৎ কিম জং উনের স্ত্রী। উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিন জং উন সম্পর্কে আমরা সবই জানি। তবে লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যান তার স্ত্রী। কারণ উত্তর কোরিয়ার ফার্স্ট লেডিকে মেনে চলতে হয় দেশটির কঠোর সব নিয়মকানুন। তাকে নিয়ে কোনো সংবাদই বাইরে প্রকাশ পায় না। তার জন্মস্থান, বয়স, বংশ পরিচয় সবই থাকে লুকানো। তবু বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে কিমের স্ত্রী রি সলের জীবন সম্পর্কে পাওয়া গেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

ছবি: ইন্টারনেট

কোনো সাধারণ পরিবারের মেয়ে ছিলেন না রি সল জু। রি সলের বাবা ছিলেন একজন কলেজ অধ্যাপক এবং মা ছিলেন একটি হাসপাতালের স্ত্রীরোগ প্রধান। এক চাচার মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার রাজ পরিবারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল রি সল জু-এর। তাকে প্রথম দেখায় ছেলের বউ বানানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন দেশটির প্রাক্তন শাসক কিম জং ইল। এরপর ২০০৯ সালে বাবার নির্দেশে এক প্রকার জোর করেই রি সলকে বিয়ে করেছিলেন কিম জং উন। বাধ্য হয়ে বিয়েতে বসেছিলেন রি সল জু’ও। কারণ প্রধান শাসকের আদেশ অমান্য করার সাহস ছিল না দেশটির কোনো নাগরিকের। ২০০৮ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন উনের বাবা কিম জং ইল। অসুস্থতার পরেই ছেলেকে বিয়ের এমন আদেশ দিয়েছিলেন তিনি।

কিম জং ইল ও কিম জং উন, ছবি: ইন্টারনেট

বিয়ের আগে রি সল জু ছিলেন উনহাসু অর্কেস্ট্রা দলের একজন গায়িকা। এটি দেশটির উচ্চ মার্গের একটি সঙ্গীত দল, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের বাছাই করে রাষ্ট্র। কিন্তু কিম জং উনকে বিয়ের পর থেকেই সবকিছু পাল্টে যায়। কড়া শাসনে দিন কাটাতে হয় তাকে। নিজের ইচ্ছামতো কিছুই করতে পারেননা এই ফার্স্ট লেডি। কি খাবেন, কি পরবেন, কোথায় যাবেন, কিভাবেই বা সাজবেন-সে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার নেই তার। সবকিছুই করতে হয় নির্দিষ্ট নিয়মের ভেতরে থেকে। বিয়ের পর প্রথম কয়েকদিন আধুনিক পোশাক পরতে দেখা গেলেও এখন আর সেসব পোশাক পরতে পারেন না তিনি। এমনকি জিন্স প্যান্ট পরাতেও আছে নিষেধাজ্ঞা। শরীরে কোন কাপড় পরবেন-তা সম্পূর্ণ স্বামী কিম জং উনের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে।

ছবি: ইন্টারনেট

এছাড়া স্বামী কিমের অনুমতি ছাড়া বাইরেও বের হতে পারেন না এই নারী। এজন্য তাকে নিজ স্বামী কিমের সঙ্গেই সবসময় দেখা যায়। শুধু তাই নয়, নিজের একটি ছবি তোলার জন্যেও পেতে হয় স্বামীর সবুজ সংকেত। এমনকি দেখা করতে পারেন না নিজ পরিবারের সদস্যদের সাথেও। বিশ্বের ক্ষমতাসীন দেশগুলোর ফার্স্ট লেডিরা বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের সাথে জড়িত থাকতেও এসব কোনো কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারেন না উত্তর কোরিয়ার ফার্স্ট লেডি রি সল জু।

জানা যায়, বিয়ের আগেই কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছেন রি সল জু। নিজের পড়ালেখা শেষ করেছেন চীনে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়াও ভ্রমণ করেছেন তিনি। কিন্তু বিয়ের পর নিজের সব স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়েছেন এই নারী। বর্তমানে দেশের বাইরে পা রাখার কোনো অনুমতি নেই এই নারীর। কোথাও যেতে হলে নিতে হয় অনুমতি আর যেতে পারেন শুধু স্বামী কিমের সাথে। রি সল বর্তমানে ৩ সন্তানের জননী। তার সন্তানদেরও বাবার অনুমতি ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ।

ছবি: ইন্টারনেট

বিয়ের ১ বছর পরই গর্ভধারণ করেছিলেন রি সল জু। সেসময়টা আরও ভয়ানক হয়ে উঠেছিল রি সলের জন্য। নিজের ইচ্ছায় ঘরের বাইরে পা রাখতে পারতেন না। সে সময় তিনি একেবারেই জনসম্মুখে আসতেন না। প্রথম সন্তান হিসেবে এই দম্পতির পরিবারে আলো নিয়ে আসে একটি ফুটফুটে কন্যা শিশু। এরপর দ্বিতীয় সন্তান হিসেবেও পৃথিবীতে আসে একটি ফুটফুটে কন্যা শিশু এবং তৃতীয় সন্তান হিসেবে তাদের কোলজুড়ে আসে একটি পুত্র সন্তান। অবাক করার বিষয়, ছেলে সন্তান না হওয়া পর্যন্ত রি সল জু-কে বারবার গর্ভধারণে বাধ্য করা হয়েছিল। আর প্রতিবারই গর্ভধারণের বিষয়টি ছিল একেবারে গোপনীয়। সেসময় রি সল জু’কে কাটাতে হতো গৃহবন্দী জীবন। বাইরে বের হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল তার জন্য। উত্তর কোরিয়ার নিয়ম অনুযায়ী, বিয়ের পর কোনো নারীকে তার স্বামীর পদবী গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু রি সল জু-এর ক্ষেত্রে ঘটেছে ব্যতিক্রমী ব্যাপার। বিয়ের পর নিজের নামই পাল্টে ফেলতে হয়েছে এই ফার্স্ট লেডিকে। এটিও হয়েছে স্বামী কিম জং উনের ইচ্ছায়। কিম জং উন বিশ্ববাসীর কাছে একগুঁয়ে, চতুর এবং স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। দেশবাসীর কাছে এর চেয়েও তার বড় পরিচয় ‘নিষ্ঠুর প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে।